আমাদের প্রথম টেস্ট জয়, এবং একটি ইতিহাস
১২:৫৩ – ১০ জানুয়ারি ২০০৫; এনামুল হক জুনিয়র টু এমপফু – বল ব্যাটে স্পর্শ করলো, সিলি মিড অফে বল আশরাফুলের তালুবন্দী। ভোঁ-দৌড় শুরু করলেন আশরাফুল, তার সাথে দৌড় শুরু করলেন বাকী ১০ জন। ড্রেসিংরুম থেকে দ্বাদশ খেলোয়াড় মাজহারুল ইসলাম রানা সহ বাকীরাও ছুটে এলেন এই আনন্দের ভাগীদার হতে, জিম্বাবুয়ের যে তখন সবকটি উইকেটের পতন ঘটেছে। ডগলাস হন্ডো আর ক্রিস্টেফার এমপফু ১৭ বলে ৯ রানের জুটিটা তখন ভেঙ্গে গেছে। আর বাংলাদেশ তুলে নিয়েছে তাদের টেস্ট ইতিহাসের প্রথম জয়।
৫ বছর ২ মাস এবং ৩৪ টেস্ট অপেক্ষার পর এসেছে বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসের সবচাইতে মধুর এই জয়। ৩৪ টেস্টে পাশে লেখা ছিলো ৩ ড্র আর ৩১ পরাজয়। জয়ের খাতায় তখনও নাম লেখানো হয়নি। জয়ের সংখ্যা শূন্য থেকে সেদিন রানের খাতা খুললো।
এই একটি জয়ের জন্য কত যে বিনিদ্র রাত কেটেছে টেস্ট জয়ের স্বপ্ন দেখা কত তরুণের, কত ক্রিকেটপ্রেমী প্রতিবার টেস্ট হারের পর আবার স্বপ্ন বুনেছেন এই একটি জয়ের, ওই সংখ্যাটা নেহাত কোটি এর কম নয়। সেদিন যারা এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে এসেছিলো “বাংলাদেশ” “বাংলাদেশ” বলে গলা ফাটাতে তারাই জানে প্রথম জয়ের এই আনন্দ আসলেই কেমন!
স্টেডিয়ামে চোখের সামনে প্রিয় দলের প্রথম টেস্ট জয় দেখার সৌভাগ্য যেমন সবার হয় না তেমনি এমন জয়ের তুলনা আর কিছুই হতে পারে না। এই একটি জয় ভুলিয়ে দেয় আগের ৩১ হারের বেদনা। সেই হার গুলোও আবার কম পীড়া দেয় নি, কখনো ইনিংস হারের বেদনা আবার কখনো বড় ব্যবধানে লজ্জার হার – মন থেকে সব কিছুকেই ধূলিসাৎ করে দিয়েছিলো আমাদের প্রথম টেস্ট জয়।
ম্যাচের স্মৃতি চারণ করতে গেলে প্রথমেই আসবে টস জিতে অধিনায়ক হাবিবুল বাশার সুমনের টস জিতে ব্যাট নেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা। এক সাক্ষাৎকারে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি জানান – ‘পরে ব্যাটিং করাটা একটু কঠিনই। আমাদের লক্ষ্য ছিল ভালো একটা স্কোর করা। প্রথম ইনিংসেই বড় রান তুলতে পারলে আমাদের যেমন বোলিং করাটা সুবিধা হবে, তেমনি প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলে দেওয়া যাবে।’ অধিনায়কের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়ে ব্যাট হাতে ব্যাটসম্যানরা বড় সংগ্রহ তুলে দিয়ে বোলারদের জন্য কাজটা সহজ করে রেখেছিলো।
প্রথমে ব্যাট হাতে দুই ওপেনার জাভেদ ওমর বেলিম এবং নাফিস ইকবালের ৯১ রানের ওপেনিং জুটি বাংলাদেশকে চালকের আসনে বসায়। বেলিম ৩৩ রানে এবং অর্ধশতক তুলে নাফিস ৫৫ রানে প্যাভিলিয়নে ফিরলেও অধিনায়ক হাবিবুল বাশার এবং মোহাম্মদ আশরাফুল দেখেশুনে ব্যাট চালাতে থাকেন। আশরাফুল ফিরে গেলে দুজনের ৬০ রানের জুটি ভেঙ্গে যায়। এরপর রাজিন সালেহকে নিয়ে একপ্রান্ত আলগে রেখে ব্যাট করে যান বাশার অন্যদিকে রাজিনও সঙ্গ দিতে থাকেন বাশারকে। চতুর্থ উইকেট জুটিতে দুজনে গড়েন ১১৯ রানের জুটি। সেঞ্চুরি থেকে মাত্র ৬ রান দূরে থাকতে এমপফুর বলে উইকেটরক্ষক তাইবুর তালুবন্দী হন অধিনায়ক হাবিবুল বাশার সুমন।
সুমনের এই ইনিংস দেখে বলাই যায় – ক্যাপ্টেন লিডিং ফ্রম দ্যা ফ্রন্ট। বাশারের বিদায়ের পরও চালকের আসনেই থাকে বাংলাদেশ। রাজিন সালেহও বাশারের মতো তিন অংকের ম্যাজিক ফিগার স্পর্শ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। সেঞ্চুরি থেকে মাত্র ১১ রান দূরে মাতসিকেনিয়ারির বলে তার হাতেই ক্যাচ দিয়ে ফেরেন রাজিন। সেঞ্চুরি মিসের মহড়ার পর হাফসেঞ্চুরি মিসের মহড়ায় যোগ দেন উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান খালেদ মাসুদ পাইলট এবং মাশরাফি বিন মর্তুজারা।
পাইলটের ৪৯, মোহাম্মদ রফিকের ৬৯ এবং শেষ দিকে মাশরাফি বিন মর্তুজার ধ্রুপদী ৪৮(৪৪) রান বাংলাদেশকে বিশাল পুঁজি এনে দেয়। বাংলাদেশ প্রথম বারের মতো টেস্ট ক্রিকেটে চারশতাধিক রান অতিক্রম করে। বাংলাদেশের মোট সংগ্রহ দাঁড়ায় ৪৮৮/১০(১৪৯.৩) ; যা তখনকার সময়ে সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ।
জিম্বাবুইয়ান বোলাদের মাঝে এমফপু সর্বোচ্চ ৪ টি উইকেট শিকার করেন। এই সিরিজ হারলে খোয়ানোর সম্ভাবনা আছে টেস্ট স্ট্যাটাস, বিশেষ করে বাংলাদেশের জন্য এই শংকা একটু বেশীই ছিলো। ব্যাটসম্যানরা তাদের কাজ পরিপূর্ণ ভাবে করে রাখায় বাংলাদেশী বোলারদের জন্য তেমন চাপ ছিলো না, কিন্তু পাহাড়সম রান চেপে ধরেছিলো জিম্বাবুইয়ান ব্যাটসম্যানদের। নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকে জিম্বাবুয়ের ব্যাটসম্যানরা। এ
কে একে মাতসিকেনিয়ারি, সিবান্দা, রজার্স, ক্রেমার, মাসাকাদজারা যখন উইকেট বিলিয়ে আসতে শুরু করেন তখন ফলোঅনের শংকা জাগে জিম্বাবুয়ে শিবিরে। টাইগার বোলাররা যখন উইকেটের নেশায় মত্ত হতে থাকে তখনই জিম্বাবুয়ের হাল ধরেন অধিনায়ক এবং উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান তাতেন্দা তাইবু। টেইলরকে নিয়ে ৬৬ রানের জুটি গড়ার পর টেইলর ফিরে গেলেও চিগুম্বুরাকে নিয়ে দলের হাল ধরেন তাইবু।
দুজনে মিলে ক্রিজ আঁকড়ে ধরে ব্যাটিং চালিয়ে যান। প্রায় ৫০ ওভার ব্যাট করে দুজনে তোলেন ১১৯ রান। শেষ পর্যন্ত দুজনের রফিকের স্পিন ঘূর্ণিতে কাটা পড়েন। তাইবু ৯২(২৪১) এবং চিগুম্বুরা ৭১(১৬৪) রানে প্যাভিলিয়নে ফিরলে জিম্বাবুয়ের স্কোর দাঁড়ায় সবকটি উইকেটের বিনিময়ে ৩১২ রান। ১৭৬ রানের লিড পায় টাইগাররা। টাইগারদের হয়ে রফিক ৫ টি, মাশরাফি ৩ টি এবং তাপস ১ টি উইকেট শিকার করেন।
বাংলাদেশ ২য় ইনিংসে ব্যাট করতে ওপেনার জাভেদ ওমরকে ছাড়াই। তার ইনজুরিতে ওপেনিং করেন রাজিন সালেহ এবং নিয়মিত ওপেনার নাফিস ইকবাল। ইনিংসে শুরুতেই নাফিসের উইকেট হারালেও চাপ সামাল দেন অধিনায়ক হাবিবুল বাশার। এবারও ‘ক্যাপ্টেন লিডিং ফ্রম দ্যা ফ্রন্ট।’ ব্যাক টু ব্যাক দুই ইনিংসেই ফিফটি তুলে নেন মিঃ ফিফটি খ্যাত এই ব্যাটসম্যান। ৩৭৯ রানের লিড নিয়ে ২০৪/৯ রানে ইনিংস ঘোষণা করেন টাইগার কাপ্তান। ৩৮০ রান তাড়া করতে হবে চতুর্থ দিনের শেষ সেশন এবং পঞ্চম দিনে, তাও আবার এই পিচে। এখানেই মানসিকভাবে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েন জিম্বাবুয়ের ব্যাটসম্যানরা।
শেষ বিকেলে ব্যাট করতে নেমে জিম্বাবুইয়ান শিবিরে তাপসের বৈশ্যের হানা। মাত্র দুইরানে ফিরিয়ে দেন দুই টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান রজার্স এবং সিবান্দাকে। দুজনেই রিক্ত হস্তে প্যাভিলিয়নে ফেরেন। শেষ বিকেলে গুরুত্বপূর্ণ ৩ উইকেট হারিয়েই ম্যাচ থেকে ছিটকে যায় জিম্বাবুইয়ানরা।
ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ চলে আসে বাংলাদেশী বোলারদের হাতে। সেই রাতে ( ৯ জানুয়ারি) বাংলাদেশী প্রত্যেক ক্রিকেটার মনে মনে জয়ের স্বপ্ন বুনেছেন হয়তোবা, হয়তোবা তাদের তাড়া করেছিলো মুলতান ট্রাজেডি। এমন অনেক স্বপ্ন বুকে রেখেই ৫ম দিন মাঠে নামে টাইগাররা।
মাত্র ৪ টেস্ট খেলা এনামুল হক জুনিয়র হয়ে উঠেন টাইগার অধিনায়কের তুরুপের তাস। একের পর এক উইকেট এনে দিচ্ছিলেন আর সবাইকে জয়ের স্বপ্নে বিভোর করে রাখছিলেন তিনি। একে একে তুলে নিলেন পাঁচ পাঁচটি উইকেট।
জিম্বাবুয়ের ইনিংসেরও তখন ৯ উইকেটের পতন। ১৬ বলে ৯ রানের এক আনুষ্ঠানিকতার জুটি পেয়েছিলো নামে মাত্রই। এরপর আসে এনামুল হক জুনিয়রের সেই মহাকাব্যিক ডেলিভারি। ঘড়ির কাটা ১২ টা ৫৩ স্পর্শ করলো আর এমপফুর সেই বল ব্যাট স্পর্শ করে সিলি মিড অফে আশরাফুলের তালুবন্দী। শুরু হলো ভোঁদৌড়, যা এখনো চলছে।
আমরা শত সহস্র ম্যাচ জিতবো কিন্তু ওই ম্যাচ জয়ের অনুভূতি শুধুই ওই ম্যাচই। ম্যাচ শেষে সবার মুখে যখন আনন্দের জয়গান, দুই বন্ধু আশরাফুল মাশরাফির মনে তখনও মুলতানের হারের বেদনা। মুলতানের সেই জয় হতে পারতো রাজসিক একজয়।
কিন্তু জয়টা এভাবেই লিখা ছিলো আমাদের। তাদের সেই বেদনা মুছে দিয়েছলো এই জয়।
সেই ইনিংসে ম্যান অব দ্যা ম্যাচ এনামুল হক জুনিয়য় এর বোলিং ফিগার : ২২.২-৫-৪৫-৬. বাংলাদেশের হয়ে সে ম্যাচে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন যারা : হাবিবুল বাশার সুমন ( অধিনায়ক), জাভেদ ওমর বেলিম, নাফিস ইকবাল, মোহাম্মদ আশরাফুল, আফতাব আহমেদ, রাজিন সালেহ, খালেদ মাসুদ পাইলট (উইকেটরক্ষক), মোহাম্মদ রফিক, মাশরাফি বিন মর্তুজা, তাপস বৈশ্য, এনামুল হক জুনিয়র, প্রয়াত মানজারুল ইসলাম রানা (দ্বাদশ ব্যক্তি)।
লিখেছেনঃ ইশতিয়াক সাহারিয়ার।